আজ বৃহস্পতিবার | ৭ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৩শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ |১লা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি | রাত ১১:৩১
আতিকুর রহমান রুমন ঃ- বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ তথা ডাকসু ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ তথা জাকসু নির্বাচন সবসময়ই যুগান্তকারী গুরুত্ব বহন করেছে। এ দীর্ঘ বিরতির পর আয়োজিত সাম্প্রতিক এ দুটি নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল বিপুল উদ্দীপনা, প্রত্যাশা ও আশাবাদ।
অনেকে মনে করেছিলেন, এবারের নির্বাচন হবে গণতন্ত্রের নতুন ভোরের সূচনা, ঘটাবে দীর্ঘ অচলাবস্থার অবসান। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। নির্বাচনের দিন এবং ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, সেই প্রত্যাশা ভেঙে গেছে কারচুপির কাছে।
দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন এবং টানা ৩৩ বছর পর ১১ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। এ ঐতিহাসিক দুটি নির্বাচন ঘিরে কোটি তরুণের বিপুল প্রত্যাশা ছিল, শেখ হাসিনার পলায়ন-পরবর্তী শাসনামলে এগুলো গণতন্ত্রের পুনরুত্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। কিন্তু যা ঘটল, তা ছিল এক কার্যত প্রহসন। মাঠের সবচেয়ে সক্রিয় ও জনপ্রিয় সংগঠন হিসাবে জরিপে এগিয়ে থাকা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে পরিকল্পিতভাবে পরাজিত করে বিজয়ী ঘোষণা করা হলো ছাত্রশিবিরকে।
নির্বাচনের আগে ৭ সেপ্টেম্বর ৩৮তম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে ভিপি প্রার্থীদের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করেছে ‘বাংলাদেশ পাবলিক একাডেমি’ ও ভলান্টিয়ার সংস্থা ‘বেসরকারি’। প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, ডাকসুর ভিপি পদে ছাত্রদলসমর্থিত প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান জনপ্রিয়তায় শীর্ষে ছিলেন, ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী তাকে সমর্থন করেছিলেন। অপরদিকে ছাত্রশিবিরসমর্থিত প্রার্থী সাদিক কায়েম ছিলেন অনেক পিছিয়ে, মাত্র ৯ শতাংশ জনপ্রিয়তা নিয়ে। অথচ ফলাফল ঘোষণার পর উলটো চিত্র সামনে আসে। বিপুল ভোটে জয়ী ঘোষণা করা হয় সাদিক কায়েমকে, আর ছাত্রদল প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। এত বড় বৈপরীত্য কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এটি ছিল সাজানো নাটকের শেষ অঙ্ক মাত্র।
ভোটগ্রহণের দিনেও নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। একাধিক হলে আগে থেকে পূরণ করা ব্যালট পেপার পাওয়া গেছে, যেগুলোতে শিবির প্রার্থীদের পক্ষে দাগানোর অভিযোগ উঠেছে। এমন খবরও পাওয়া গেছে যে, ছাত্রদলের পর্যাপ্তসংখ্যক এজেন্টকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, কোথাও বা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। বহিরাগত জামায়াত-শিবির কর্মীদের ভুয়া পরিচয়ে ভোট দিতে দেখা গেছে। অথচ ছাত্রদলের প্রার্থীদের নানা অজুহাতে বাধা দেওয়া হয়েছে। টিএসসি ও রোকেয়া হলে তো প্রকাশ্যেই ধরা পড়েছে আগেভাগে পূরণ করা ব্যালট পেপারের প্রমাণ।
ভোট গণনার সময়ও স্বচ্ছতা ছিল না। নিয়মভঙ্গ করে শিবির প্রার্থী নিজেই গণনা কক্ষে প্রবেশ করেছেন। ভোট গণনা শেষ হওয়ার পরপরই এলইডি স্ক্রিনে ফলাফল প্রকাশ করার কথা থাকলেও তা হয়নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, ডাকসুর ভোট গণনা শেষ হবে ৩-৪ ঘণ্টায়; কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। সিসিটিভি ফুটেজ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ফলাফল নিয়ে সন্দেহকে আরও জোরালো করে।
ছাত্রদল ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, তাদের ‘এতিমের মতো দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘ব্যালট আগে থেকেই পূরণ করা ছিল। দুপুরের পরপরই অনুমান করেছি, পরিকল্পিত কারচুপির এ ফলাফল হবে।’ এ বক্তব্য শুধু এক ক্ষুব্ধ প্রার্থীর ক্ষোভ নয়, বরং ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য।
শুধু ছাত্রদল নয়, স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও একই অভিযোগ করেছেন। ভিপি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী উমামা ফাতেমা নির্বাচনকে ‘সম্পূর্ণ নির্লজ্জ কারচুপির নির্বাচন’ আখ্যা দিয়ে বর্জনের ঘোষণা দেন। জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল ভোট চলাকালেই অনিয়মের প্রতিবাদে বর্জনের ঘোষণা দেয় এবং ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে। সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো, জাকসুর দুজন নির্বাচন কমিশনারও পদত্যাগ করেছেন; যা প্রমাণ করে, নির্বাচন কমিশনও নিরপেক্ষ থাকতে পারেনি।
নানা কারণে ডাকসু-জাকসুর নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। যে যার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তবে জুলাই গণআন্দোলনের প্রথম সারির নেতাদের নেতৃত্বে গঠিত গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ভরাডুবির পর তাদের নীরবতা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেখানে প্রায় সব সংগঠনই ডাকসু-জাকসু নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, সেখানে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতারা যেন নির্বাক দর্শক। এ নীরবতা জনমনে সন্দেহ জাগিয়েছে, প্রকারান্তরে কি তারা শিবিরসমর্থিত প্যানেলের বিজয়ে সন্তুষ্ট? ডাকসু নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ভরাডুবির সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে জুলাই আন্দোলনের নেতাদের জনপ্রিয়তার এ রকম পতন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। নির্বাচনে কারচুপির সামান্যতম প্রতিবাদ না করায় জনমনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগছে, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ কি তবে শিবিরের সঙ্গে কোনো গোপন সমঝোতায় গিয়েছিল?
ডাকসু-জাকসু নির্বাচনে ফলাফলের হিসাব আরও অস্বাভাবিক। ডাকসুর ২৮ পদের মধ্যে ২৩ পদে জয়লাভ করেছে ছাত্রশিবির। ছাত্রদল, যারা মাঠে সক্রিয়তা ও জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে ছিল, তাদের ভাগ্যে জুটেনি একটিও পদ। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ পদে বিজয়ী হয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরসমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের প্রার্থীরা। তারা জাকসুর ২৫ পদের মধ্যে সাধারণ সম্পাদক (জিএস), দুটি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ (এজিএস) ২০ পদে জয় পেয়েছেন। এমন ফলাফল ছাত্রসমাজ মেনে নিতে পারেনি। এটি আসলেই শিক্ষার্থীদের রায়ের প্রতিফলন নয়; বরং পূর্বনির্ধারিত এক নাটকের পরিণতি।
ডাকসু নির্বাচনে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অভিযোগ এনে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রক্টরিয়াল বডিসহ নির্বাচনে সম্পৃক্ত শিক্ষক এবং অন্যদের বেশির ভাগ জামায়াত-শিবিরসমর্থিত ছিল। ফলে নির্বাচনে ছাত্রশিবিরসমর্থিত প্যানেল আলাদা সুবিধা পেয়েছে।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই জামায়াত-শিবিরসমর্থিত। ফলে তারা নির্বাচনে একচেটিয়া সুবিধা পেয়েছে। ভোটে কারচুপি হলেও তা ওই সুবিধার কারণে ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয় ছাত্রশিবির।’ আবার নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের আঁতাতের কারণেও নির্বাচনের ফলাফলের মোড় ঘুরে যায় বলে দাবি করেন তিনি।
খোরশেদ আলম আরও বলেন, ‘ভোটের হার যেটা দেখানো হয়েছে, সেটাও সন্দেহজনক। ভোটের দিন সকালে ভোটারদের উপস্থিতি থাকলেও দুপুরের পর তা ছিল না। তাহলে এত ভোট কীভাবে পড়ল?’
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও এ বিষয়ে অনেক কিছু বলে দেয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস স্পষ্ট করে অভিযোগ করেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে ছাত্রলীগের ভোট শিবিরকে পাইয়ে দেওয়া হয়েছে।’
লেখকঃ- আতিকুর রহমান রুমন,আহ্বায়ক , আমরা বিএনপি পরিবার ও সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল।
বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫ | |
ওয়াক্ত | সময় |
সুবহে সাদিক | ভোর ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ |
সূর্যোদয় | ভোর ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ |
যোহর | দুপুর ১২:৪৩ অপরাহ্ণ |
আছর | বিকাল ৪:০০ অপরাহ্ণ |
মাগরিব | সন্ধ্যা ৬:২৬ অপরাহ্ণ |
এশা | রাত ৭:৪২ অপরাহ্ণ |