আজ বুধবার | ২রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ |২৬শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি | রাত ১১:২১

ড. একেএম শামছুল ইসলাম: বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জন কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিলো না; এটি ছিল কয়েক দশক ধরে জমে থাকা বৈষম্য, বঞ্চনা, রাজনৈতিক অধিকার হরণ এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধের চূড়ান্ত পরিণতি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান ছিল শোষণের প্রতিচ্ছবি। অর্থনীতি, সামরিক বাহিনী, প্রশাসন, ভাষা, সংস্কৃতি সর্বত্রই ছিল বৈষম্য ও বঞ্চনার এক কঠিন বাস্তবতা। বাঙালি জাতি বারংবার উপলব্ধি করেছে চলমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে তাদের ছিলো না সম্মানজনক ও ন্যায়সঙ্গত বন্দোবস্ত। সেই বঞ্চনা থেকেই জন্ম নিয়েছিল জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা— যা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তর-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে জনগণের সুস্পষ্ট রায়ের মাধ্যমে ক্রমশ দেশের মানুষের নিকটবর্তী হতে থাকে।
তবে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নির্বাচনে জনগণের রায় মেনে নিতে অস্বীকার করলে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে।
অতঃপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অভাবনীয় নৃশংসতা চালিয়ে জাতির পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দেয়। সেই মুহূর্তে জাতি ছিল নেতৃত্বহীন, তথ্যবিচ্ছিন্ন ও গভীর অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত। ঠিক সেই সময় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, সেটি ছিলো অন্ধকারের বিপরীতে আলোর উদ্ভাস। তাঁর ঘোষণা শুধু একটি রাষ্ট্রের জন্মের পূর্বাভাস ছিলো না বরং সেই ঘোষণা জাতিকে করেছে একত্রিত, প্রতিরোধকে করেছে সুসংগঠিত, ফিরিয়ে এনেছে জনগণের আত্মবিশ্বাস।
স্বাধীনতার ঘোষণা ছিলো সামরিক, রাজনৈতিক, কৌশলগত— সব দিক থেকেই যুগান্তকারী। এটি ছিলো পাকিস্তানি দমনযজ্ঞের বিরুদ্ধে বাঙালির সর্বপ্রথম সমন্বিত প্রতিক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ও সংঘবদ্ধ প্রয়াসের এক অনিবার্য সূচনা। যখন জাতির সম্মুখের ভবিষ্যৎ ছিলো দারুণ অস্পষ্ট, তখন মেজর জিয়ার কণ্ঠে উচ্চারিত স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালির প্রতিরোধকে নৈতিক ভিত্তি ও বৈধতা দেয়। এই ঘোষণা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে অটুট করে তোলে, সাধারণ মানুষকে প্রতিরোধে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানিয়ে দেয়— বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের অংশ নয়; এটি একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র, যার সংগ্রাম ন্যায়সঙ্গত, মানবিক ও যার বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
স্বাধীনতা ঘোষণার পর মেজর জিয়া সম্মুখসমরে ফিরে গিয়ে গঠন করেন ‘জেড ফোর্স’, যার বীরত্ব, কৌশল ও সংগঠনের দক্ষতার কথা আজ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা। তাঁর নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস করে, গেরিলা হামলার মাধ্যমে শত্রুকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে মেজর জিয়ার অবদান শুধু একজন সামরিক কমান্ডারের নয়; তিনি ছিলেন মানুষকে সংগঠিত করার নেতৃত্বশক্তি, প্রেরণার উৎস এবং স্বাধীনতার সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশক।
কিন্তু এই মহান মুক্তিযুদ্ধে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আছে— যা অনেক সময়ই ইতিহাসের আনুষ্ঠানিক বর্ণনায় উপেক্ষিত থাকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া’র অবদান ইতিহাসে গভীরভাবে প্রোথিত। তাঁর স্বামী মেজর জিয়া সম্মুখসমরে লড়াই করছেন— এই সময় পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর পরিবারকে অবরুদ্ধ করে, নজরদারিতে রাখে, মানসিক নির্যাতনে বিপর্যস্ত করে। বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ছোট সন্তানদের নিয়ে গৃহবন্দী হন এবং অসাধারণ সাহস, দৃঢ়তা এবং দেশপ্রেমে অটল থেকে আপসহীণ রয়ে যান।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল— মেজর জিয়ার অবস্থান জানার জন্য, তাঁর মনোবল ভাঙার জন্য। কিন্তু তিনি দৃঢ় ছিলেন, অবিচল ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাই বলেছেন— “যুদ্ধের সময় বেগম জিয়া ছিলেন নীরব কিন্তু অটুট এক শক্তি।” তাই তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়— তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র ধরেননি ঠিকই, কিন্তু শত্রুর মুখে দাঁড়িয়ে থেকেছেন অনড়, তথ্য করেছেন গোপন, পরিবারকে সুরক্ষিত রেখেছেন এবং মেজর জিয়াকে তাঁর লক্ষ্যে অবিচল ও স্থিত থাকার নৈতিক শক্তি যুগিয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীদের ত্যাগ ও অবদান অপরিসীম এবং বেগম খালেদা জিয়া সেই অবদানের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।
তাঁর এই ভূমিকার মধ্য দিয়েই বোঝা যায়— মুক্তিযুদ্ধ কেবলমাত্র একটি সামরিক সংগ্রাম ছিলো না; এটি ছিলো পরিবার, সমাজ, নারী ও পুরুষ সকলের সম্মিলিত প্রয়াস।
এরই ধারাবাহিকতায় আসে ১৬ ডিসেম্বরের মহান বিজয়— যা শুধু একটি যুদ্ধের সমাপ্তি ছিলো না; এটি ছিলো হাজার বছরের বাঙালির রাষ্ট্রিক পরিচয়ের পরিণত প্রকাশ। এই বিজয় নিপীড়িত মানুষের মুক্তির প্রতীক, ন্যায়–সাম্য–মানবিকতার ওপর ভিত্তি করে নতুন সমাজ বিনির্মাণের অঙ্গীকার। বাঙালি আর পাকিস্তানের অনুগামী নয়; সে এখন স্বাধিকার, মর্যাদা ও জাতীয় গৌরবের অধিকারী।
স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জও ছিল বিশাল। বিরাট ধ্বংসস্তূপ, যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা— সব মিলিয়ে দেশ গড়তে দরকার ছিল সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন এক দৃঢ়চেতা রাষ্ট্রনায়ক। এখানে আবারো মেজর জিয়া জাতিকে নেতৃত্ব দেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন— যদি রাষ্ট্রকে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে দাঁড় করাতে হয়, তবে মানুষকে একটি বৃহত্তর জাতীয় পরিচয়ে আবদ্ধ করতে হবে। এই উপলব্ধি থেকেই জন্ম নেয় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা— যা ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, অঞ্চল নির্বিশেষে সকল নাগরিককে সমান মর্যাদায় একই পতাকাতলে আবদ্ধ করে। তাঁর নেতৃত্বে রাষ্ট্র রাজনীতিতে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, অর্থনীতিতে মুক্তবাজার অর্থনৈতিক কাঠামো বিকাশ লাভ করে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ মর্যাদার অবস্থান তৈরি করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই মূল প্রতিপাদ্য— ন্যায়, সাম্য, মানবিকতা আজও আমাদের রাষ্ট্রজীবনের অবিচ্ছেদ্য ভিত্তি। আর এই প্রতিপাদ্যের উত্তরসূরি হিসেবে উঠে এসেছেন তারেক রহমান, যিনি মেজর জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়া’র পরম্পরাকে নতুন যুগে, নতুন প্রজন্মের ভাষায় আরও সুস্পষ্ট ও গ্রহণীয় করে তুলছেন।
এদিকে, জনাব তারেক রহমান মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শুধু স্মৃতির মধ্যে ধরে রাখেন না; তিনি এটিকে জীবন্ত রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিণত করেন। তাঁর বক্তব্যে, তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে, তাঁর নেতৃত্বে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত— রাষ্ট্রের মালিক জনগণ; গণতন্ত্রের ভিত্তি মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশ; আর রাষ্ট্রক্ষমতার আসল অংশীদার মানুষ।
২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আমরা দেখেছি— মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই গণআন্দোলন, সেই স্বতঃস্ফূর্ততা, সেই সাহস আবার নতুনভাবে ফিরে এসেছে নতুন প্রজন্মের মধ্যে। তারেক রহমানের ডাক, তাঁর অনুপ্রেরণা, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তরুণদের মধ্যে তৈরি করেছে নতুন আশার আলো— যে রাষ্ট্র আমরা চাই তা হতে হবে মানুষের, ন্যায়ের, বাক স্বাধীনতার রাষ্ট্র; কোনো স্বৈরাচার, কোনো দুঃশাসন, কোনো দুর্নীতির স্থান সেখানে থাকবে না।
অতীতে তরুণেরা পাকিস্তানি দমননীতির বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে যেমন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন— তেমনি অন্যায়, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নতুন করে দাঁড়িয়ে গেছেন। ঠিক যেন ১৯৭১-এর চেতনাই আবার ২০২৪-এ এসে নবজন্ম লাভ করেছে। এই পুনর্জাগরণের নেতৃত্বে থাকা তারেক রহমান তাই কেবল রাজনৈতিক নেতাই নন; তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তরসূরি, তিনি নতুন প্রজন্মের পথপ্রদর্শক— যিনি অতীতের আদর্শকে ভবিষ্যতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে নতুন এক জাতীয় নবজাগরণের সূচনা করেছেন।
আজকের প্রজন্মের অনেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, কিন্তু তারা স্বাধীনতার মূল্য বোঝে— কারণ তাদের সামনে আছে শহীদ জিয়া, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সংগ্রামের ধারাবাহিকতা।
মহান স্বাধীনতা শুধু একটি দিনের বিজয় নয়; এটি প্রতিদিন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব জাগ্রত রাখার অঙ্গীকার। ‘১৬ ডিসেম্বর’ তাই আমাদের জন্য গৌরবের পাশাপাশি দায়িত্ব প্রতিপালনেরও দিন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে ন্যায়, সাম্য, মানবিকতার রাষ্ট্র গড়ার দায়িত্ব আজকের বাংলাদেশের মানুষেরই। এখানেই বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের প্রকৃত শক্তি।
আমরা সেই জাতি যারা জনযুদ্ধ করে মহান স্বাধীনতা অর্জন করেছি, আমরা সেই জাতি যারা দমন পীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে জানি, আমরা সেই জাতি যারা ত্যাগকে শ্রদ্ধা করতে জানি। তারেক রহমানের সঠিক নেতৃত্ব স্বাধীন, দমন পীড়ন বিরোধী ত্যাগী এক জাতিসত্তার ধারণা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরে তাদেরকে আবারো আবারো জাগিয়ে তুলছেন।
তাঁর এই জেগে ওঠার আহ্বানই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
আর এই আলোকিত ভবিষ্যৎই আমাদের স্বাধীনতার প্রতিজ্ঞা।
লেখক: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামছুল ইসলাম, পিএসসি, জি (অব.), সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ | |
| ওয়াক্ত | সময় |
| সুবহে সাদিক | ভোর ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ |
| সূর্যোদয় | ভোর ৭:৩৪ পূর্বাহ্ণ |
| যোহর | দুপুর ১২:৫৪ অপরাহ্ণ |
| আছর | বিকাল ৩:৫৫ অপরাহ্ণ |
| মাগরিব | সন্ধ্যা ৬:১৫ অপরাহ্ণ |
| এশা | রাত ৭:৩৬ অপরাহ্ণ |