আজ মঙ্গলবার | ২৪শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৮ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ |১৩ই মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি | রাত ১১:১৭

শিরোনাম :

সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ডিএমপির গণবিজ্ঞপ্তি আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি নির্বাচনের আগে ফ্যাসিস্টদের অবশ্যই বিচার হবে : উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গত তিনটি নির্বাচনকে যারা সার্টিফিকেট দিয়েছে সেসব পক্ষপাত দুষ্ট বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অনুমোদন দেওয়া হবে না ড. সালেহউদ্দিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প শুল্ক ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন মির্জা ফখরুল’র নেতৃত্বে চীন সফর প্রতিনিধি দলের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সৌজন্য সাক্ষাৎ বিএনপি’র নাম ভাঙিয়ে যারা অপকর্মের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে দল থেকে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে:রুহুল কবির রিজভী যুক্তরাষ্ট্রসহ আটটি দেশে ভোটার নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে ইসি আগামী ১০ থেকে ১২ জুলাইয়ের মধ্যে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হতে পারে যে সমস্ত জায়গায় আমরা একমত হতে পারি, সেই জায়গায় যেন আমরা আসতে পারি, সেই চেষ্টা আমাদের থাকতে হবে’-উল্লেখ করেন আলী রীয়াজ গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি ৪৯২ জন ,৩ জনের মৃত্যু

দেশ কাঁপানো ৩৬ দিন

প্রকাশ: ৮ জুলাই, ২০২৫ ১২:২৩ অপরাহ্ণ

প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান : গত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশ শুধু দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ ছিল না, ছিল একটি দমবন্ধ, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র। মানুষ কথা বলতে পারত না, চোখ তুলে তাকাতে পারত না, এমনকি বিশ্বাস করত না যে, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। সরকার, বিচার ব্যবস্থা, আইন সবকিছু এক বিশাল কারাগারের প্রাচীরে রূপ নিয়েছিল। গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। নির্বাচনের নামে চলেছে প্রহসন, আর বিরোধী কণ্ঠস্বরকে রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউই মুক্ত ছিল না—না ছাত্র, না শিক্ষক, না সাংবাদিক, না সাধারণ নাগরিক।
আমি ছিলাম সেই কারাগারের এক প্রতিবাদী বন্দি। শুধুমাত্র মতপ্রকাশের অপরাধে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্যায়ভাবে অপসারণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রদ্রোহসহ অগণিত কাল্পনিক মামলার বোঝা নিয়ে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়। যেদিন আমার বাসা থেকে উচ্ছেদ করা হয়, সেদিন আমার ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রী কাঁদছিলেন, আর আমাদের মেয়ে জানালা দিয়ে নির্বাক তাকিয়ে ছিল।
সেই বিশ্ববিদ্যালয় আবার জেগে উঠেছিল। কিন্তু আমি, একজন নির্বাসিত শিক্ষক, দূর থেকে অনুভব করছিলাম এই জাগরণ কেবল ছাত্রদের নয়, আমারও এক ধরনের পুনর্জন্ম। খবরে, ভিডিওতে, ছাত্রদের মুখে শুনছিলাম, টিএসসিতে কিছু ছাত্র দাঁড়িয়ে গেছে নিঃশব্দে। কারও হাতে লেখা পোস্টার: ‘আমার সোনার বাংলায়—বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ এই একটি বাক্যে যেন সারাদেশের হতাশা, জ্বালা, আশা- সবকিছু মিশেছিল।
৪ জুলাই, যখন আপিল বিভাগ কোটা বহাল রাখে, তখন ছাত্রদের চোখে যে রাগ আর আত্মবিশ্বাস দেখলাম- তা যেন আমার নিজের দৃষ্টিতে ফিরে এল। ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধের বিস্ফোরণ ঘটল। আমি বহু অবরোধ দেখেছি, কিন্তু এবারকার প্ল্যাকার্ড, দেয়াল লিখন, মুখের স্লোগান, চোখের ভাষা সব ছিল ভিন্ন। তারা বলছিল, ‘কোটা না মেধা- মেধা, মেধা’, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম এই লড়াই কেবল কোটা-বিরোধী নয়, এটি এক লাঞ্ছিত প্রজন্মের আত্মমর্যাদা উদ্ধারের আন্দোলন।
এক যুগের বেশি জনগণের ভোটাধিকার ডাকাতি করে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখা প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ৭ জুলাই বলেন: ‘এই আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই।’ আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। চারিদিকে স্লোগান, রাজপথে ছাত্রদের চোখে প্রতিজ্ঞা, শহীদ মিনারে মানুষের ঢল আর তিনি বলছেন অযৌক্তিক? ইতিহাসে যখনই কোনো অবৈধ শাসক এমন মিথ্যা উচ্চারণ করেছেন, তার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ।
১৪ জুলাই শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা কোটা নিয়ে আন্দোলন করছে, তারা রাজাকারদের নতি-পুতি।’ এই কথায় কোনো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল না, এটি ছিল ইচ্ছাকৃত অপমান। অপমানের শিকার হল দেশের সবচেয়ে মেধাবী, সাহসী আর সংবেদনশীল প্রজন্ম। একজন অবৈধ শাসক জাতির সন্তানদের বিরুদ্ধে ছুঁড়ে দিলেন চরিত্রহননের ঘৃণ্য অপবাদ। বিগত বছরগুলোতে বহুবার আমাকে শুনতে হয়েছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘গণদুশমন’। কিন্তু এবার দেখলাম, একটি সম্পূর্ণ প্রজন্মকে একযোগে রাজাকার বলা হলো, শুধু তাদের ন্যায্য দাবির কারণে। এই কথার প্রতিক্রিয়া ছিল সর্বব্যাপী, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে ধ্বনিত হচ্ছিল নতুন স্লোগান: ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার! কে বলেছে, কে বলেছে- স্বৈরাচার, স্বৈরাচার!’ আর এক কোণে, এক ছাত্রী দেয়ালে লিখছিল শক্ত হাতে: ‘চাইলাম অধিকার, হলাম রাজাকার!’ এই বাক্যগুলোই হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ, এক বিপন্ন প্রজন্মের কণ্ঠস্বর, যাকে রাষ্ট্র চেপে রাখতে চেয়েছিল।
১৫ জুলাই দুপুরে শুরু হয় দমনযজ্ঞ, নেমে আসে রাষ্ট্রের বাহিনী ও ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের ওপর গরম পানি নিক্ষেপ করা হয়, ছেলেদের মাথা ফাটানো হয় লোহার রড দিয়ে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মুখে কাপড় বেঁধে, হাতে অস্ত্র নিয়ে ঘুরছিল, যেন রাজপথে বিচরণ করে বেড়ানো একদল হায়েনা। তারা ঢুকে পড়ে হাসপাতালে, অসহায় চিকিৎসাধীন আহত শিক্ষার্থীদের আবারও আঘাত করে। একজন আহত ছাত্রী রক্তাক্ত মুখে বলেছিল: ‘সুস্থ হয়েই আবার যাব মিছিলে, আমার দাবি ছাড়ব না।’ আমি বুঝলাম, ইতিহাস বদলে যাচ্ছে। এবার আর কেউ মুখ বন্ধ করতে পারবে না।
১৬ জুলাই দুপুরে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একটি ভিডিও। একজন ছাত্র বুক চিতিয়ে, দু’হাত তুলে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সেই নিরস্ত্র ছাত্রকে পুলিশ সরাসরি গুলি করে হত্যা করে। তার নাম আবু সাঈদ। বয়স ২৩। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র, কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। সে ছিল মিছিলের সামনের সারিতে। আমি ভিডিওটি একবার দেখেছিলাম, তারপর আর পারিনি। সাঈদ আমার ছাত্র হতে পারতো, সন্তানও হতে পারতো। আমি বুঝলাম, এই শাসক শুধু গণতন্ত্র হত্যা করেনি, সত্যিকারের প্রতিবাদকেই রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করেছে।
সেদিন বিকেলে সারাদেশে গর্জে ওঠে ছাত্রসমাজ। আকাশের দিকে উঠে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত। তারা শুধু স্লোগান দেয়নি, তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। অসীম সাহসী, টগবগে তরুণরা সারাদেশে ছাত্রলীগের-যুবলীগে-হেলমেটলীগের গুলিতে নিহত হয়। এক‌ই সময় চট্টগ্রামে শহীদ হয় ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম।
প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত হলগুলো দখল করতে শুরু করে। আমি দেখলাম, যে সংগ্রামের জন্য আমাকে শিক্ষকতা হারাতে হয়েছে, মামলা খেতে হয়েছে, পরিচয় হারাতে হয়েছে, আজকের প্রজন্ম সেই সংগ্রামকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। আমি হারিয়ে যায়নি, আমার উত্তরসূরিরা যুদ্ধ করছে, বুক ফুলিয়ে, চোখ তুলে। আবু সাঈদের মায়ের আর্তনাদ: ‘তুই মোর ছাওয়াক চাকরি না দিবু না দে, কিন্তু মারলু ক্যানে?’ এই একটি লাইনেই যেন রাষ্ট্রের সমস্ত অহঙ্কার, মিথ্যা আর বর্বরতা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
পরদিন সকাল থেকে দেশজুড়ে হয় গায়েবানা জানাজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা কালো ব্যানার হাতে, মাথায় কালো কাপড় বেঁধে জড়ো হয়। কেউ কোনো মাইক ব্যবহার করেনি, কেউ দলীয় ব্যানারও তোলেনি, তবু শোকের ঘনত্বে বাতাস ভারী হয়ে যায়। একটা নিরবতা ভেদ করে ভেসে আসে কণ্ঠস্বর: ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না!’ আরেকদিক থেকে প্রতিধ্বনি ওঠে: ‘ভাই হত্যার বিচার চাই!’ এ যেন শোক নয়, রক্তের প্রতিজ্ঞা।
রাষ্ট্র সহ্য করতে পারল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে, জাহাঙ্গীরনগরের অ্যাডমিন ভবনের সামনে আবার নেমে আসে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট, রড আর ব্যাটন। সেদিন দুপুরে আসে আরেক নির্দেশ, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খালি করে দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা তখন জানাজা শেষে ক্যাম্পাসে ফিরছিল, কেউ আহত বন্ধুকে খুঁজছিল, কেউ দু’দিন কিছু খায়নি। হঠাৎ মাইকে ঘোষণা, ‘হল ছাড়ো। ক্যাম্পাস বন্ধ।’ শুধু ঢাকায় নয়- রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রংপুর; সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আদেশ একযোগে কার্যকর হয়। এটি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় কৌশল; শিক্ষার্থীদের বিচ্ছিন্ন করে আন্দোলনের শেকড় কেটে ফেলার চেষ্টা। সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। স্বজন হারানোর মেকি কান্না। অন্যায়, অপশাসন, নির্যাতন জায়েজ করার চিরাচরিত প্রহসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খালি করার পর সরকার ভেবেছিল, আন্দোলন থেমে যাবে। কিন্তু তারা ভুল করেছিল হিসাবের অঙ্কে। ১৮ জুলাই সকালেই ঢাকার রাজপথে নামে এক নতুন সুনামি; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ব্র্যাক, ইস্ট ওয়েস্ট, নর্থ সাউথ, আইইউবি, এআইইউবি, নর্দান, মাইলস্টোন; আরও জানা-অজানা প্রতিষ্ঠান সহ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা একযোগে রাস্তায় নামে। তারা গরম, ধুলোমাখা রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকে: ‘গণহত্যার বিচার চাই!’ গলায় ঝোলানো আইডি কার্ড, কাঁধে ব্যাগ, মাথায় পতাকা, কিন্তু বুকের ভেতর জ্বলছিল আগুন। অগ্রজদের সাথে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই-বোনেরা রাস্তায় নেমে আসে। এদের অনেকেই আর ঘরে ফেরেনি। মুগ্ধ, পনি বিলাতে বিলাতে মাথায় গুলি খেয়ে শহীদ হয়। ১৭ বছরের কিশোর ফাইয়াজ শহীদ হয় ধানমন্ডিতে। উত্তরা, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। দুপুর থেকে হেলিকপ্টার থেকে কাঁদানে গ্যাস আর গুলি বর্ষণ শুরু হয়। বাসার ভেতর, ছাদে, মায়ের কোলে শিশুরাও মারা যায়। এই শহর, যে শহর একদিন ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল, আজ তারই আকাশ থেকে জালিম সরকার নামিয়ে আনে যুদ্ধ। ঢাকার প্রতিটি মোড়ে, বাসস্ট্যান্ডে, গলির মাথায় ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধ। সান্ধ্য আইন জারি করা হলো। এর কিছু পরেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট। আন্দোলন এইবার কেবল রাজপথে নয়; প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে মিশে যায়।
সন্তানদের লাশের সারি দিনে দিনে লম্বা হচ্ছিল। কোনোটি বাসার সামনে পড়ে ছিল, কোনোটি হাসপাতালের বারান্দায়, কোনোটি রাস্তায়, কোনোটি চুপচাপ কবরে চলে গেছে কোনো ঘোষণা ছাড়া, বেওয়ারিশ পরিচয়ে। ডানদিকে লাশ, বাঁদিকে গ্রেফতার, আর মাঝখানে নিঃশব্দে রক্ত চুঁইয়ে পড়া শহর। শিশু, কিশোর, যুবক, যারাই স্লোগান দিয়েছিল, তাদের তালিকা তৈরি করে তুলে নেওয়া হচ্ছিল। রাতে রিকশা থামিয়ে ব্যাগ তল্লাশি, বাসা থেকে ঘাড় ধরে ছেলে ধরে নিয়ে যাওয়া, ডিবি অফিসে পেটানোর পর মিডিয়াতে নাটক, ‘তারা নিজের ইচ্ছায় আন্দোলন স্থগিত করেছে।’ এই ছিল রাষ্ট্রের নাট্যশালা, যেখানে সত্যকে পিষে মিথ্যার রক্ত ছিটানো হতো। তাদের পরিবার কাঁদছে, আর মিডিয়াতে চলছিল অনুষ্ঠান: ‘আন্দোলন দেশের উন্নয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’
সারাদেশে তৈরি হলো এক অদ্ভুত জাগরণ। দোকানদার বলল, ‘ভাই, আমার ভাইও মারা গেছে।’ রিকশাচালক বলল, ‘মামারা, আপনাদের সাথে থাকুম, যা লাগে বইলেন।’ শিক্ষকরা এসে বললেন, ‘তোমরা এগিয়ে যাও, আমরা পেছনে থাকব।’ মা গ্রেফতার হওয়া সন্তানকে বলে ‘বাবা ভয় নেই।’ বোন দাঁড়িয়ে পড়ে পুলিশের গাড়ির সামনে ‘আমার ভাইকে নিতে দিব না।’ তার মাঝেও দালাল সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের খেলা থামায়নি। প্রতিদিন টকশোতে বসে বলা হচ্ছিল, ‘বিদেশি এজেন্ট, জামায়াত, রাজাকার, ষড়যন্ত্র!’ আন্দোলনের যে শিশু মারা গেছে, তাকেও ‘চক্রের অংশ’ বলা হলো। হাসিনার মেট্রো স্টেশনে দাঁড়িয়ে অভিনয়; তিনি গিয়েছিলেন ভাঙ্গা কাঁচের ছবি তুলতে।
প্রতিদিনের সংবাদপত্র ভরে উঠল লাশের ছবিতে। তবু মানুষ থামেনি। শুধু ছাত্র না—শিক্ষক, কৃষক, কবি, মা, বোন, প্রবাসী ছাত্র, ছিন্নমূল, হকার, সবাই এসে দাঁড়িয়েছিল একই শব্দে: ‘এই রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’ প্রবাসীরা তাদের কষ্টার্জিত মুদ্রা পাঠানো বন্ধ করে অভিনব প্রতিবাদ জানায়। সামাজিক মাধ্যমে লাল রঙ হয়ে উঠে প্রতিবাদের প্রকাশ।
এই দমনযজ্ঞের মধ্যে এক আশ্চর্য প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল শহরের দেয়ালজুড়ে। রঙ তুলি হাতে শিক্ষার্থীরা সব দেওয়াল ভরিয়ে তুলছিল গ্রাফিতিতে। কোথাও শহীদদের নাম, কোথাও রক্তে লেখা প্রতিবাদ, কোথাও মুখোশ খুলে ফেলার আহ্বান। তাদের স্লোগান, কবিতা, প্রশ্ন, সব কিছুই ফুটে উঠেছিল রঙে, বাক্যে, লাল কালিতে। দেওয়ালে লেখা হয়, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারে বাপের না।’ এই দেয়ালগুলো হয়ে উঠেছিল সত্যিকারের সংবাদপত্র, এই লাইনগুলো হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের মিথ্যার জবাব। এই তরুণরাই বুঝিয়ে দিয়েছিল, যেখানে শব্দ চাপা পড়ে, সেখানে রং কথা বলে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীদের ওপর নেমে আসে আরেক দফা নির্যাতন। মাঠের ছেলেরা গুম হয়, কর্মীদের উঠে বসার আগেই পিটানো হয়। আইনজীবীরা বিবৃতি দেন, ‘রাষ্ট্র আইনের তোয়াক্কা করছে না।’ গ্রেফতার এড়াতে আমার আর বাসায় থাকা হয়ে উঠল না- থাকলাম পথে পথে, পরিবার ছেড়ে, এক বন্ধু থেকে আরেক বন্ধুর বাসায়, মোবাইল বন্ধ করে। আমার অপরাধ, আমি প্রশ্ন করেছি, আমি লিখেছি, আমি স্বপ্ন দেখিয়েছি। আর বিশ্ব? জাতিসংঘ বলল, ‘এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্ত জরুরি।’ ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলল, ‘বাংলাদেশের জনগণের পাশে আছি।’ তবু কেউ হাসছিল, কেউ অস্বীকার করছিল, কেউ ব্যঙ্গ করছিল, কেউ বলছিল, ‘সবাই সন্ত্রাসী।’
আন্দোলন পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। ৪ আগস্ট সকাল থেকেই ঢাকার রাজপথে একটাই আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাই!’ হাজার হাজার মানুষ জড়ো হচ্ছিল শাহবাগ, টিএসসি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, কার্জন হল। শহীদ মিনার থেকে ঘোষণা এলো, ‘এই রক্তের পাহাড় পেরিয়ে আর ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’ এই দিনেই প্রথম ঘোষণা আসে, ‘ঢাকামুখী লংমার্চ’। প্রথমে বলা হয় ৬ আগস্ট হবে, কিন্তু বিকেলের পরপরই বিক্ষোভকারীদের চাপ, জনতার উত্তেজনা ও শহীদদের সংখ্যার ভারে সিদ্ধান্ত হয়, লংমার্চ হবে পরের দিনেই, ৫ আগস্ট। ঢাকায় বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল এক নিরব প্রতিজ্ঞায়, পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত পিছু হটা নয়। ‘বুকের ভিতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি, গুলি কর।’
৫ আগস্ট সকাল বেলা, দীর্ঘ প্রতিক্ষীত মহেন্দ্রক্ষণ, ঢাকা শহর যেন নিঃশ্বাস আটকে বসে ছিল। সবাই জানত, কিছু একটা ঘটবে, একটা বিস্ফোরণ, কিংবা রক্তস্নান। জরুরি বার্তায় ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেত্রী ঘোষণা দিয়েছিল: ‘সাত মিনিটেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’ ডিএমপি কমিশনার বলেছিলেন: ‘আমি মার্চ টু ঢাকা হতে দেব না।’ গণভবন ঘিরে যুদ্ধের প্রস্তুতি, মেশিন গান বসানো। ঢাকায় ঢোকার প্রতিটা মুখে রণসজ্জা। কিন্তু মানুষ তো ভয় জয় করে ফেলেছে। তারা আসছিল চারদিক থেকে, পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, লাখে, লাখে। তারা ছিল নিরস্ত্র, সংকল্পে অটল। তারা হেঁটে চলেছিল গণভবনের অভিমুখে, শান্ত, অবিচল। ‘তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়; সেই ভয়ের টুঁটিই ধরব টিপে, করব তারে লয়।’
‘শেখ হাসিনা পালায় না।’ এই কথাটাই তো তিনি নিজে বলেছিলেন মাত্র কিছুদিন আগে, জনস্মুখে, দম্ভভরে। কিন্তু ৫ আগস্ট দুপুরে সেই শেখ হাসিনাই পালিয়ে গেলেন। কোনো ক্যামেরা ছিল না, ছিল না কোনো ঘোষণা, শুধু তাড়াহুড়ো, আতঙ্ক, আর অপমান। যে জালিম ষোলো বছর ধরে দেশের গলার উপর পা দিয়ে রেখেছিলেন, তিনি পালালেন, পণ্য বহনের বিমানে করে, ভারতে। এক সংক্ষিপ্ত বার্তা চোখের পলকে চাউর হয়ে যায়, ‘শেখ হাসিনা পালাইছে।’ শুনে যেন শহরের আমেজই বদলে গেল। মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ল, কেউ হাসল, কেউ কাঁদল, কেউ চিৎকার করল। মিষ্টির দোকান নিমিষে খালি। অন্তহীন দুঃস্বপ্ন যেন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল। তবু সবখানে শেষরক্ষা হয়নি। যাত্রাবাড়ী, চাঁনখারপুল, সাভার, এসব জায়গায় কিছু ‘নির্বোধ বাহিনী’ শেষ মুহূর্তে গুলি ছুড়েছিল। নিহত হন অনেকেই, তাদের রক্তেও ভিজে থাকে সেই দিনের পতাকা।
কিছুই থামাতে পারেনি জেগে ওঠা বিজয়ী জনতাকে। তারা ঢুকে পড়ে গণভবনে। আরেকদল ছুটে যায় সংসদ ভবনের দিকে। তারা বলে, এই সংসদ আর কেবল একটি দলের নয়, এখন এটি পুরো জাতির। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ছাদে দেখা যায় পতাকা উড়াচ্ছে হাজারো তরুণ। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও ঢাকার বিভাগীয় অফিস, সব ক’টি দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। কে আগুন দিল? আগুন দিয়েছিল গুম হয়ে যাওয়া বাবার পুত্র, সন্তান হারানো বাবা, বন্ধু হারানো কিশোর, সহোদর হারানো ভাই।
‘শেখ হাসিনা পালাইছে।’ এই শব্দটি শুধু বিজয়ের উল্লাস নয় এটা একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষার ভারমুক্তি। এই ইতিহাস কেউ মুছতে পারবে না। এখন সময় এই ইতিহাসকে সংরক্ষণ করার, শহীদদের নাম রক্ষার, প্রতিরোধের স্মারক গড়ে তোলার। আমি এই রাষ্ট্রের সেই শিক্ষক, যাকে বলা হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহী। আজ আমি বলছি—এই রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক ছিল সেই সব তরুণ-তরুণী, যারা চোখ তুলে বলেছিল: ‘তুমি কে, আমি কে? বিকল্প! বিকল্প!?’
লেখক: প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান
প্রফেসর মার্কেটিং বিভাগ ও আহ্বায়ক, সাদা দল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সদস্য সচিব, জুলাই গণঅভ্যুত্থান উদযাপন কমিটি, বিএনপি।

(সূত্র : বিএনপি মিডিয়া সেল)

বাংলাদেশ মিডিয়া রাজনীতি লেখকের কলাম

আরও পড়ুন

গত ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ

  • আর্কাইভ

    ঢাকা বিমানবন্দরে ৮৯৬ গ্রাম সোনাসহ ২ জনকে আটক করেছে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ

    এখনো মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ,শামীম হায়দার পাটওয়ারীকে মহাসচিব নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ: সংবাদ সম্মেলনে বহিষ্কৃত সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল

    সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ডিএমপির গণবিজ্ঞপ্তি

    ষড়যন্ত্রকারী যত চেষ্টাই করুক; সফল হবে না, জনগণের সরকারই আগামী নির্বাচনে প্রতিষ্ঠিত হবে – আমিনুল হক

    কুষ্টিয়ায় র‌্যাবের যৌথ অভিযানে চাঞ্চল্যকর আলী প্রামানিক হত্যা মামলার প্রধান আসামি গ্রেফতার

    রাজধানীর বনানী থানা বিএনপির বিরুদ্ধে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করলো উত্তর বিএনপি

    দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ’র জন্য গাজীপুর , নরসিংদী ও সাভার উপজেলার তিন নেতাকে বহিস্কার করেছে বিএনপি

    রাজধানীর কলাবাগানে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ অভিযানে পুলিশ ছদ্মবেশী চাঁদাবাজ গ্রেফতার

    আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি নির্বাচনের আগে ফ্যাসিস্টদের অবশ্যই বিচার হবে : উপদেষ্টা আসিফ নজরুল

    গত তিনটি নির্বাচনকে যারা সার্টিফিকেট দিয়েছে সেসব পক্ষপাত দুষ্ট বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অনুমোদন দেওয়া হবে না

    ড. সালেহউদ্দিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প শুল্ক ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন

    দেশ কাঁপানো ৩৬ দিন

    নড়াইলে প্রশিক্ষণের শুভ উদ্বোধন করলেন এসপি এহসানুল কবীর

    নওগাঁর পত্নীতলায় সড়ক দুর্ঘটনায় একজন নিহত

    নওগাঁর পত্নীতলায় হত্যা মামলার আসামী গ্রেফতার

    মির্জা ফখরুল’র নেতৃত্বে চীন সফর প্রতিনিধি দলের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সৌজন্য সাক্ষাৎ

    খুলনা সদর এলাকায় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর যৌথ অভিযানে অবৈধ অস্ত্রসহ শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেফতার

    বিএনপি’র নাম ভাঙিয়ে যারা অপকর্মের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে দল থেকে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে:রুহুল কবির রিজভী

    জাতীয় পার্টিতে ফের পাল্টাপাল্টি পরিস্থিতি সৃষ্টি

    বিএনপির ৩১ দফা প্রচারে উত্তরখানে লিফলেট বিতরণ ও পথসভা অনুষ্ঠিত

    যুক্তরাষ্ট্রসহ আটটি দেশে ভোটার নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে ইসি

    জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে কুষ্টিয়ায় মানববন্ধন :৩ বছরেও কুলকিনারা হয়নি সাংবাদিক রুবেল হত্যার

    আগামী ১০ থেকে ১২ জুলাইয়ের মধ্যে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হতে পারে

    যে সমস্ত জায়গায় আমরা একমত হতে পারি, সেই জায়গায় যেন আমরা আসতে পারি, সেই চেষ্টা আমাদের থাকতে হবে’-উল্লেখ করেন আলী রীয়াজ

    নড়াইলে স্ত্রীসহ ডাকাত সর্দার গ্রেফতার

    রাণীশংকৈল প্রেসক্লাব সাবেক সভাপতি মোবারক আলী’র মায়ের দাফণ জানাযা সম্পন্ন

    গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি ৪৯২ জন ,৩ জনের মৃত্যু

    সরকারের ভেতরে সরকার?

    প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট (পিজিআর) এর ৫০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি

    শেখ হাসিনা, ছোট বোন শেখ রেহানা ও ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়সহ ১শ’ জনকে আদালতে হাজির হতে গেজেট প্রকাশ


    • মঙ্গলবার, ৮ জুলাই, ২০২৫
      ওয়াক্তসময়
      সুবহে সাদিকভোর ৪:৫১ পূর্বাহ্ণ
      সূর্যোদয়ভোর ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ
      যোহরদুপুর ১:০৪ অপরাহ্ণ
      আছরবিকাল ৪:২৩ অপরাহ্ণ
      মাগরিবসন্ধ্যা ৭:৪৯ অপরাহ্ণ
      এশা রাত ৯:১৬ অপরাহ্ণ
  • সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুল হাসান বাবলু
    ই-মেইলঃ dk.kamrul@gmail.com
    copyright @ বাংলাদেশ দিনকাল / বিডি দিনকাল ( www.bddinkal.com )
    বিডি দিনকাল মাল্টি মিডিয়া (প্রা:) লিমিটেড প্রতিষ্ঠান।